সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০১:০১ অপরাহ্ন

বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো টাকা যাচ্ছে হুন্ডির দখলে

বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো টাকা যাচ্ছে হুন্ডির দখলে

বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় তিন মাস আগে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা এবং সেবা বন্ধ করে দেয়ার পর বিপদে পড়েছে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা। অনেকেই বিকল্প হিসেবে টিউশন ফি এবং পড়াশোনার খরচ এখন অবৈধ পথে হুন্ডি করে পাঠাতে শুরু করেছেন।

বহ্নি আক্তার নামে এক নারীর বড় ছেলে গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করতে গেছে। সেই সময় একটি বেসরকারি ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি এবং অন্যান্য খরচ পাঠানো হয়েছে।

কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে তারা আর ব্যাংকিং চ্যানেলে ছেলের কাছে পড়াশোনার খরচ পাঠাতে পারছেন না।

‘প্রতিমাসে ছেলের বাসা ভাড়া, যাতায়াত, খাবারের টাকা পাঠাতে হয়। ছয় মাসে একবার সেমিস্টার ফি দিতে হয়। আগে তো সহজেই ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা এদিকে পড়েছি বিপদে, আর আমার ছেলে ওদিকে আছে বিপদে,’ বলেছেন বহ্নি আক্তার।

গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে বাধ্য হয়ে তারা ছেলের কাছে মাসের খরচ পাঠাচ্ছেন হুন্ডি বা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে।

’খরচ তো পাঠাতে হবে। এখন খরচ একটু বেশি হলেও হুন্ডি করে টাকা পাঠানো শুরু করেছি,’ তিনি বলেন।

এখানে বহ্নি আক্তারের নামটি আসল নাম নয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে তার নামটি বদলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু তার মতো একই বিপদে রয়েছেন বাংলাদেশের আরো শতাধিক অভিভাবক। সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগাতে বাধ্য হয়ে তারা সবাই অবৈধ বা হুন্ডির মতো ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

যেভাবে সঙ্কট গভীর হয়েছে
ডলার সঙ্কটের কারণে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো।

আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এরকম কোনো নির্দেশনা না দেয়া হলেও, ব্যাংকগুলো বলছে, ডলার সঙ্কটের কারণে তারা স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে পারছে না।

নভেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সমিতি অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স-এর ভাইস চেয়ারম্যান, সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী মাশরুর আরেফিন বলেছিলেন, ডলার সঙ্কটের কারণে নতুন স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।

ওই সময় ১৬ নভেম্বর বিবিসি বাংলাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ঠিক এখন যেটা হচ্ছে, এখন অগ্রাধিকারের তালিকায় তাদের বিদেশে পড়াশুনো করতে যাওয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, বেঁচে থাকতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ আমদানি পণ্য সেগুলোকে সাপোর্ট দেয়া।

আপনারা জানেন ডলারের একটা সঙ্কট চলছে। আমাদের ব্যাংকে রেমিটেন্স এবং এক্সপোর্ট থেকে যে ডলার আসে সেই ইনফ্লোর চেয়ে আউটফ্লো বেশি। এটা সাময়িক একটা সমস্যা আমরা শিগগিরই এটা কাটিয়ে উঠবো। কিন্তু এখনো পরিস্থিতি বদলায়নি।

এরপর থেকে বিদেশে যারা উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চান, তারা ভর্তি ফি, টিউশন ফি তো পাঠাতে পারছেনই না, বরং যারা বর্তমানে পড়াশোনা করছেন, তারাও দেশ থেকে খরচ নিতে পারছেন না।

অভিভাবকদের ভোগান্তি
নাজমা আক্তারের মেয়ে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু কড়াকড়ির কারণে তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশ থেকে টিউশন ফি পাঠাতে পারেননি।

লন্ডনে থাকা পরিচিত একজন ব্যক্তির বাংলাদেশে থাকা পরিবারকে তারা নগদ টাকা দিয়েছেন। ওই ব্যক্তি লন্ডনে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি জমা দিয়ে দিয়েছেন।

এভাবে হুন্ডি বা বিকল্প পথে টিউশন ফি পাঠানোর পথ বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশী অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার।

কিন্তু কেবল টাকা পাঠাতেই ভোগান্তি নয়, তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হলে প্রতি ডলার কিনতে হতো ১০৮ টাকা হারে। কিন্তু হুন্ডিতে সেটা কিনতে হয়েছে ১১৪ টাকা দরে।

তারপরেও তারা বাধ্য হয়ে সন্তানের জন্য হুন্ডি ব্যবহার করে ডলার পাঠিয়েছেন।

সাধারণত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনেচ্ছু একজন শিক্ষার্থী শুরুতে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার ডলার পাঠিয়ে থাকে।

প্রতি ছয় মাস পরপর তাদের ১০ হাজার করে ডলার পাঠাতে হয়। এছাড়া মাসিক থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের জন্য গড়ে দুই থেকে চার হাজার ডলার পাঠাতে হয় অভিভাবকদের।

বাংলাদেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চ সেমিস্টারে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে যায়।

অভিভাবকেরা বলছেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা নিতে চায় না।

কিন্তু বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ইমেইল করে, পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে অনুরোধ করার পর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান টাকা নিতে রাজি হচ্ছে।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, প্রধান কার্যালয় থেকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে না বলা হয়েছে। যেসব ফাইল এখন খোলা আছে, এমনকি সেগুলো ব্যবহার করেও ডলার পাঠানো বন্ধ রয়েছে।

এলসি পেমেন্টের জন্যই তো আমরা ডলার দিতে পারছি না। এখন স্টুডেন্টদের জন্য কিভাবে দেব?

অনেক গ্রাহক এসে অনুরোধ করছেন, কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। শুনেছি অনেকে বিকল্প নানা ব্যবস্থা করছেন, বলেছেন একটি শাখার ব্যবস্থাপক পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংর্কাস বাংলাদেশের সদস্য ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এখনো স্টুডেন্ট ফাইল পুরোপুরি আগের মতো একেবারে ওপেন করে দেয়ার মতো অবস্থা ব্যাংকগুলোর হয়নি।

কোনো কোনো ব্যাংক এখন খুলছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরেকটু সময় লাগবে। আশা করা যায়, হয়তো এপ্রিলের পর পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হবে।

হুন্ডি দখল করে নিচ্ছে উচ্চশিক্ষার অর্থ
জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২১ সালে সাড়ে আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী গেছেন দেশটিতে।

এছাড়া মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াতেও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে যান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ থেকে ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877